সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শাহরাস্তিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন মানোন্নয়ন প্রকল্পে হরিলুট  

বেলায়েত সুমন


২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সমতল ভূমিতে বসবাসরত অনগ্রসর ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর জীবন মানোন্নয়নে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন’শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী  কমিটি (একনেক)। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত দেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান অঞ্চলকে বাদ দিয়ে দেশের সমতল অঞ্চলের ২৯ জেলার ২১০ উপজেলায় বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের নিয়ে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়।প্রকল্পে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার,খুলনা,সাতক্ষীরা, বরগুনা,পটুয়াখালী অঞ্চলের রাখাইন, ত্রিপুরা, মুন্ডা, বুনো, এবং বকবানিয়া জনগোষ্ঠীর লোকদের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চল -৪ এর আওতাভুক্ত করা হয়। শুরু থেকেই চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে নানান অনিয়মেই প্রকল্পের কার্যক্রম চলতে থাকে।ফলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের বদলে বঞ্চিত হওয়ার নতুন আরেক অধ্যায়ের সূচনা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে,প্রকল্প শুরুর পরই প্রকল্পের আনুষাঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের জন্য ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তার অনুকূলে ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় প্রকল্প থেকে।এরপর শুরু হয় প্রকল্পের কাজ।প্রথমেই উপজেলায় বিপ্লব চন্দ্র বর্মন নামে পৌর এলাকায় বসবাসরত একজন ফিল্ড ফ্যাসিলেটেটরকে খন্ডকালীন নিয়োগ দেয়া প্রকল্প থেকে।পরবর্তীতে এই ফিল্ড ফ্যাসিলেটেটর পৌর এলাকার শ্রীপুর ও সাহাপুর থেকে ২৯ জন জেলে পরিবারের সদস্যদের ভোটার আইডি কার্ড ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে শাহরাস্তি উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিসে জমা দেয়।যদিও প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প এলাকায় সুফলভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেঞ্চমার্ক সার্ভে (প্রশ্নপত্র জরিপ) পদ্ধতি অবলম্বন করে উপজেলা প্রাণীসম্পদ দফতরের প্রত্যেক তত্ত্বাবধানে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তালিকা তৈরির কথা ছিল।বেঞ্চমার্ক পদ্ধতি অবলম্বন না করেই নিজের পাড়া প্রতিবেশিদের নাম তালিকাভুক্ত করেন ফিল্ড ফ্যাসিলেটেটর বিপ্লব চন্দ্র বর্মন।এরপর ২০২১- ২০২২ অর্থবছরের নভেম্বর মাসে তালিকাভুক্ত সুফলভোগীদের দুই দিনের স্থলে নামকাওয়াস্তে একদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।প্রকল্পের সুফলভোগীদের তালিকা আর শাহরাস্তি উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তার মাস্টাররোলে সংরক্ষিত প্রশিক্ষণ শেষে ভাতা নেয়া সুফলভোগীদের  তালিকায় নামের অমিল থাকায় বিপত্তি দেখা দেয়। প্রকল্প অফিসে প্রেরিত সুবিধাভোগীর তালিকায় একই উপজেলার সাহাপুর গ্রামের মানিক চন্দ্র বর্মন ও আশু চন্দ্র বর্মনের নাম চূড়ান্তভাবে থাকলেও তারা কোনো প্রশিক্ষণ ও ভাতা পাননি।
প্রকল্পের আওতায় আধুনিক পদ্ধতিতে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের লক্ষ্যে উন্নতজাতের ঘাস উৎপাদন ও সংরক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের  কথা থাকলেও  শাহরাস্তি উপজেলায় নামনাত্রই চলছে প্রকল্পের ঘাস চাষ ও বাজার সৃষ্টি কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে প্রকল্প এলাকায় বেঞ্চমার্ক সার্ভে অনুযায়ী প্রকল্পের সুফলভোগীদের মধ্য হতে কেউ একজন ঘাস চাষের ফ্লট ও বাজার সৃষ্টির কথা থাকলেও প্রকল্পের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্রকল্পে মাসভিত্তিক বেতনে কর্মরত ফিল্ড ফ্যাসিলেটেটর বিপ্লব চন্দ্র বর্মনকে ঘাস চাষের জন্য ও ঘাসের বাজার সৃষ্টির জন্য উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ মাকসুদ আলম প্ররোচিত করার অভিযোগ পাওয়া যায়।এরই ধারাবাহিকতা অনুসন্ধানে জানা যায়, বিপ্লব চন্দ্র বর্মন নিজেই মাত্র আধা শতাংশ জমিতে নামমাত্র ঘাস চাষ করেন।তবে ঘাসের কোনো বাজার সৃষ্টি করতে পারেননি।ফলে প্রকল্পের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে না।এই খাতে উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তার অনুকূলে ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও সে বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানান।প্রকল্পের মাধ্যমে শাহরাস্তি উপজেলায়  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও আমিষের চাহিদা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের নানান অনিয়মে তা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।কচ্ছপ গতিতে চলা প্রকল্পের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে নামমাত্র বরাদ্দ আর প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাহরাস্তি উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তার তথ্যগোপন ও প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের পায়তারায়।উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও অনুসন্ধানে অনিয়মের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রকল্পের ডিপিপি সংস্থান অনুযায়ী, শাহরাস্তি উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৯জন  সুফলভোগীর মধ্যে ২৩ জন সুফলভোগী প্রকল্পের মাধ্যমে  সাতটি প্যাকেজের প্রথম প্যাকেজে একটি  উন্নত জাতের ক্রসব্রিড বকনা বাছুর পাওয়ার সংস্থান ছিল।সংস্থান অনুযায়ী সুফলভোগীদের মধ্যে উপজেলার পৌর শ্রীপুর গ্রামের নিমাই চন্দ্র বর্মন সে বকনা বাছুর পায়।২০২০-২০২১ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে  প্রকল্পের বাজেট অর্ডার নং ৩২৩ অনুযায়ী  বাছুরের ঘর পায় নিমাই চন্দ্র বর্মন।পরবর্তীতে  আপদকালীন খাদ্য সহায়তা হিসেবে বাছুরের ৯ বস্তা খাদ্য সহায়তা পান তিনি। প্রকল্পের দ্বিতীয় প্যাকেজে (৬ টি প্যাকেজের প্রতিটিতে ২০ টি) সোনালী মুরগী,অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ ব্যবদ সহায়তা ও তিন মাসব্যাপী খাদ্য সহায়তার ডিপিপি সংস্থান থাকলেও উপজেলায় তালিকাভুক্ত সুফলভোগীদের কেউ সোনালী মুরগী,মুরগীর বাসস্থান নির্মাণ সহায়তা ও তিন মাসের খাদ্য সহায়তা এখনও পায়নি কেউ। প্রকল্পের তৃতীয়  প্যাকেজে (৬ টি প্যাকেজের প্রতিটিতে ২০ টি) খাঁকি ক্যাম্বেল হাঁস ,অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ ব্যবদ সহায়তা ও তিন মাসব্যাপী খাদ্য সহায়তার ডিপিপি সংস্থান থাকলেও উপজেলায় তালিকাভুক্ত সুফলভোগীদের কেউ খাকি ক্যাম্বেল হাঁস, হাঁসের বাসস্থান নির্মাণ সহায়তা ও তিন মাসের খাদ্য সহায়তা এখনও পায়নি কেউ। প্রকল্পের চতুর্থ  প্যাকেজে(২ টি প্যাকেজের প্রতিটিতে ২ টি) ব্লাক বেঙ্গল ছাগল  ,অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ ব্যবদ সহায়তা ও তিন মাসব্যাপী খাদ্য সহায়তার ডিপিপি সংস্থান থাকলেও উপজেলায় তালিকাভুক্ত সুফলভোগীদের কেউ  ব্লাক বেঙ্গল ছাগল, বাসস্থান নির্মাণ সহায়তা ও তিন মাসের খাদ্য সহায়তা এখনও পায়নি কেউ। প্রকল্পের পঞ্চম  প্যাকেজে(২ টি প্যাকেজের প্রতিটিতে ২ টি) ভেড়া ,অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ ও তিন মাসব্যাপী খাদ্য সহায়তার ডিপিপি সংস্থান অনুযায়ী উপজেলার পৌর এলাকার লিটন চন্দ্র বর্মন নামে এক সুফলভোগী দুইটি পুরুষ ভেঁড়া পেয়েছেন। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের নভেম্বর মাসে প্রকল্পের বাজেট অর্ডার ১৫৫৩ অনুযায়ী ভেঁড়ার অস্থায়ী গৃহ নির্মাণ উপকরণ বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী গৃহ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।তবে লিটন চন্দ্র ভেঁড়ার তিন মাসের আপদকালীন খাদ্য সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছেন উপজেলা উপসহকারী প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা মোঃ রুহুল আমিন।কেনো তিনি ভেঁড়ার আপদকালীন খাদ্য সহায়তা পাননি তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনননি উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ফিল্ড ফ্যাসিলেটেটর।প্রকল্পের ষষ্ঠ  প্যাকেজে (৬ টি প্যাকেজের প্রতিটিতে ১ টি) মহিষ  ,অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ ব্যবদ সহায়তা ও তিন মাসব্যাপী খাদ্য সহায়তার ডিপিপি সংস্থান থাকলেও উপজেলায় তালিকাভুক্ত সুফলভোগীদের কেউ  মহিষ,বাসস্থান নির্মাণ সহায়তা ও তিন মাসের খাদ্য সহায়তা এখনও পায়নি কেউ।প্রকল্পের সপ্তম  প্যাকেজে (১ টি প্যাকেজে ১ টি) হৃষ্টপুষ্টকরণ গরু ,অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ ব্যবদ সহায়তা ও তিন মাসব্যাপী খাদ্য সহায়তার ডিপিপি সংস্থান থাকলেও উপজেলায় তালিকাভুক্ত সুফলভোগীদের কেউ গরু,বাসস্থান নির্মাণ সহায়তা ও তিন মাসের খাদ্য সহায়তা এখনও পায়নি কেউ।
প্রকল্পের আওতায়  শাহরাস্তি উপজেলায় মাত্র দুটি পুরুষ ভেঁড়া ও একটি ক্রসব্রিড বকনা পেয়েছেন দু’জন সুফলভোগী।দুটি ভেঁড়া ও একটি বকনার জন্য
 চলতি বছরের মে মাসে প্রকল্প থেকে শাহরাস্তি উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তার বরাবরে  ভ্যাটরেনারী মেডিসিন,ভিটামিন এন্ড মিনারেলস ও এন্টিসেফটিক সহ মোট ৭২৯ টি ঔষধ প্রেরণ করা হয়েছে।এর মধ্যে ইঞ্জেকশন রয়েছে ১৩১ টি।ঔষধ এখনো  সংশিষ্ট দফতরে এসে পৌঁছেনি।এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ড. অসীম কুমার দাস  বলেন,সারা বছরের জন্য ঔষধ পাঠানো হয়েছে।দুই ভেড়া আর এক বকনার জন্য এতো ঔষধ কেনো? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রকল্প পরিচালক বলেন,প্রকল্পের সুফলভোগীরা ভবিষ্যতে আরও উপকরণ পাবে।
প্রকল্পে অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক, ড. অসীম কুমার দাস  জানান, অনিয়ম সম্পর্কে যেহেতু জেনেছি সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেব।তাছাড়া এ প্রকল্পে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর  আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি দারিদ্র হ্রাস জীবনমান উন্নয়ন নামমাত্রই হচ্ছে? এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সংস্থান অনুযায়ী পরবর্তীতে বরাদ্দ দেয়া হবে।
চাঁদপুর জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা বলেন,একজন প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানেন না তা তো হতেই পারে না। কিছু না জানলে তিনি কিসের জ্বালানী ভাতা নিয়েছেন? আর প্রকল্পের তথ্য দিতে কেনইবা তিনি অনিহা প্রকাশ করছেন তা আমার বোধগম্য নয়।সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে সাংবাদিকদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে আপত্তি থাকবে কেনো?
প্রকল্পে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহরাস্তি উপজেলার দায়িত্বরত উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ মাকসুদ আলম প্রকল্প সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে জানান।”তথ্যের প্রয়োজন হলে তথ্য অধিদপ্তর থেকে নিতে পারেন। আমার এখানে কোনো তথ্য নেই।আপনি আমার কাছে এতো তথ্য চাইতে পারেন না। প্রকল্প সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না বলে জানালেও প্রকল্পে সুবিধাভোগীদের প্রশিক্ষণ ভাতা ৩১হাজার ৩৫০ টাকা উত্তোলনের একটি কাগজে তাঁর সিল স্বাক্ষর রয়েছে এমনকি প্রকল্পের ২০২১ সালের মে মাসে জ্বালানী ভাতা তোলেন বলে প্রমাণ রয়েছে।

Comments are closed.

More News Of This Category